ঢাকা,বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

ধর্ষণ: জাতির লজ্জা

0102_108219চট্টগ্রামের পটিয়ার ১৭ বছর বয়সী মেয়েটি প্রতিবন্ধী। বুদ্ধির স্বাভাবিক বিকাশের সীমাবদ্ধতা জন্ম থেকেই। জন্ম থেকেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই তার পথচলা। কিন্তু বখাটে, দুশ্চরিত্র ছেলেদের হাত থেকে রেহাই মেলেনি তারও। ধর্ষকদের নোংরা প্রবৃত্তি স্পর্শ করেছে তাকে। অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া মেয়েটির পরিবার বিচার চেয়ে মামলা করেছিল থানায়। আর তাতেই যেন সব অপরাধ! বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মেয়েটির পরিবারকেই উল্টো একঘরে করে দেওয়া হয়েছে। মামলা তুলে নেওয়ার চাপ এসেছে। বন্ধ হয়ে গেছে বড় বোনের কলেজে যাওয়া। সমাজের এরকম হাজারো খ-চিত্র একত্র করলে বোঝা যাবে, নারী নিরাপত্তার পারদ নিচুতেই ধাইছে। যদিও নারী নির্যাতনের প্রকৃত পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া ভার। সরকার ও বেসরকারি সংস্থা মিলিয়ে যেটুকু মিলছে তা আতঙ্কের বার্তাই দিচ্ছে।

২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে নারী নির্যাতন বেড়েছে অর্ধেকের বেশি। কারণ কী? অনেক কিছু। কিন্তু তার মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হবে তা বিচারহীনতা। ধর্ষণের ঘটনা দেশে নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নারীকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে কুরুচিকর পৌরষত্বের। বিকৃত মানসিকতার কিছু অপরাধী ঘটাচ্ছে এসব কুকর্ম। কিন্তু ধর্ষণের কটি ঘটনার বিচার হয়েছে আজ পর্যন্ত? ধর্ষকের বিচার কি আদৌ হয়? ধর্ষণের ঘটনার পর বিচারের দাবিতে সোচ্চার হতে হয় সচেতন মানুষকে। আন্দোলন গড়ে তুলতে হয় দোষীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার। প্রশ্ন, কেন ধর্ষণের পর বিচার দাবিতে আন্দোলন করতে হয়? নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নানা সময় অঙ্গীকার প্রকাশ করা হয়েছে। তারপরও পুলিশ কেন এসব অভিযোগের প্রতিকারে উদাসীনতা দেখায়? সমালোচক আর সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, নারীর প্রতি সামগ্রিক মনোভাবই এর জন্য দায়ী।

বছর কয়েক আগে বখাটের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শিশু তৃষা। সাঁতার জানা ছিল না। পানিতে ডুবেই মৃত্যু হয়েছে প্রাথমিকের পাঠ চুকাতে না পারা মেয়েটির। ওই ঘটনায় বখাটের কিছু হয়েছে বলে জানা যায়নি। তৃষার মৃত্যুর জন্য ওই বখাটে কি দায়ী ছিল না? তবে কেন তার সাজা হয়নি? দেশজুড়ে আলোচনায় এখন তনু। সোহাগী জাহান তনুর নির্মম মৃত্যু। কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় গত ২০ মার্চ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই শিক্ষার্থীর মরদেহ পাওয়া যায়। প্রথমে তনুর মরদেহের যে ময়নাতদন্ত করা হয়েছিল তার প্রতিবেদনে পুলিশ বলেছিল এটি একটি হত্যা। কিন্তু হত্যার আগে ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের কোনো তথ্য ছিল না ওই প্রতিবেদনে।

তনুর হত্যার বিচার দাবিতে গোটা দেশ ফুসছে। বিষয়টি গড়িয়েছে উচ্চ আদালতেও। নির্দেশ আসে আবার মরদেহ তুলে ময়নাতদন্ত করার। এবারও ময়নাতদন্ত করেছে পুলিশ। তবে প্রতিবেদন আগের মতো হয়নি। পুলিশ বলছে, হত্যার আগে ধর্ষণ করা হয়েছিল তনুকে। এছাড়া মাথা ও কানের পেছনের জখমের কথাও এখন বলা হচ্ছে। মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদনের এই ভিন্নতাও নতুন প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। তনু হত্যার সঙ্গে জড়িতদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। কারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত সেই ধোঁয়াশাও কাটেনি। যেহেতু একটি বিশেষ বাহিনীর রক্ষিত এলাকায় মিলেছে মরদেহ সেহেতু আন্দোলনকারীদের অভিযোগের আঙুল ওদিকটাতেই ইশারা করছে। যদিও সেনাবাহিনীর মুখপাত্ররা বলছেন, হত্যা বাইরে ঘটিয়ে খুনিরা মরদেহ ভেতরে ফেলে যেতে পারে। কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা সেনানিবাস এলাকায় এমন কা- কি বাইরের কারো পক্ষে করা সম্ভব? যদি তাই হবে তাহলে প্রশ্ন উঠবে সেনানিবাসের নিরাপত্তা নিয়েও।

নারীরা শুধু ঘরে কিংবা জনমানবশূন্য স্থানেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে না, চলন্ত বাসেও ধর্ষিতা হচ্ছে নারী। ছোটো শিশু থেকে শুরু করে পূর্ণবয়স্কা বাদ থাকছেন না কেউ। এ ধরনের বিকৃত রুচির সমুচিত জবাব দেওয়া উচিত আইন দিয়ে, বিচার করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ধর্ষণ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ধর্ষকদের আরও বেপরোয়া করেছে। করেছে আইনের প্রতি অশ্রদ্ধাশীলও। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, যারা ধর্ষণ করেন তারা স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আলাদা কেউ না হলেও তাদের আচার-আচরণে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফুটে উঠে। সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন কারণে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ এস এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘যে সব মানুষ সারা দিন যৌনতা, যৌন চাহিদা স¤পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তারাই প্রধানত ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ করে থাকে। তারা বিকৃত যৌনতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে যৌনতা নিয়ে বিকৃত চিন্তা-ভাবনা করতে করতেই তারা ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজ করে।’ সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ এও মনে করেন, ধর্ষণের পেছনে যত না যৌন আকাক্সক্ষা থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে প্রতিশোধপরায়ণতা এবং আক্রোশ। ভুক্তভোগী বা তার স্বজনদের অপমান করা, কখনো কখনো কোনো গোষ্ঠী বা সমাজ অথবা জাতির সম্মানহানির জন্যও যুগে যুগে এই ধর্ষণ চলে আসছে বলেও মনে করেন দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিকরা। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না বাড়লে এই সমস্যা থেকে মুক্তি কঠিন বলেও মনে করেন তারা।

লজ্জায় মুখ খোলেন না ভুক্তভোগীদের বড় অংশ

ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের কোনো সঠিক তথ্য মেলে না কখনই। কারণ অনেক আগে থেকেই দেশের রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার কারণে ধর্ষণ কিংবা নির্যাতনের শিকার অনেকেই ঘটনা আড়াল করেন। মুখ খুললে সামাজিকভাবে হেনস্তা কিংবা হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার ভয় থাকে এজন্য গোপন রাখেন এসব ঘটনা। আবার যারা মুখ খুলতে চান তারা জানেন না কোথায় গেলে সঠিক বিচার পাওয়া যাবে। বাস্তবতা বলে, সমাজে ধর্ষণকারী বা ধর্ষকের চেয়ে ধর্ষিতার দিকে মানুষ আঙুল তোলে বেশি। যেন ধর্ষকের কোনো দোষই নেই, সব দোষ ভুক্তভোগীর। সবাই ধর্ষিতাকে হেয় করে। তাকে একটু আলাদা দৃষ্টিতে দেখে। যে কারণে অনেক ধর্ষণের ঘটনাই জানা যায় না।

লোকচক্ষুর আড়ালে অনেকে চোখে অশ্রু ঝরায়। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টোটা। যে এ ধরনের কুকর্ম করেছে তাকেই কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা দরকার ছিল। পাশাপাশি তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে সমাজের অন্যদের মধ্যে বার্তা পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন যে, ধর্ষণ করলে বিচারের হাত থেকে রেহাই মিলবে না।

বাড়ছে শিশু ধর্ষণ

২৫০টির বেশি মানবাধিকার সংগঠনের জোট শিশু অধিকার ফোরামে বলছে, গত ৭ মাসে বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৮০টি। শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুছ সহীদ মাহমুদ বলেন, গত বছর এই সংখ্যা ছিল ১৯৯টি। আর ২০১৩ সালে ১৭০টি এবং ২০১২ সালে ছিল ৮৬টি। এই সংখ্যা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরেও থাকতে পারে। এই শিশুদের মধ্যে বস্তি এলাকায় বসবাসকারীর সংখ্যা বেশি। যাদের বাবা-মা দুজনেই আয়ের জন্য বাইরে কাজে যান তাদের সংখ্যাও কম নয়। শিশুরা ধর্ষণের শিকার হন প্রতিবেশীদের দ্বারা। এছাড়া পথশিশুরাও বিভিন্ন সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হন। যারা কাউকে কিছু বলতে পারেন না। আবার বলেও কোনো প্রতিকার হয় না।

আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা মাদ্রাসাগুলোতেও ছেলে শিশুরা তাদের শিক্ষকদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রায়ই এসব ঘটনার খবর সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে। কদিন আগে পাবনায় ছাত্রকে যৌন নির্যাতন করার দায়ে এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কিছুদিন আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার একটি আবাসিক মাদ্রাসার ছাত্র তার শিক্ষকের দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠায় পুলিশ ওই শিক্ষককে আটক করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক মাদ্রাসা শিক্ষক নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বীকার করেছেন। তবে এই বিষয়টিতে ধর্ষণের শিকার ছেলেটির পরিবারের সদস্যরা প্রথমে উদ্যোগ নিলেও পরে আর মামলা করতে এগিয়ে আসেনি বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামাল উদ্দিন।

পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। বেশিরভাগ শিশু ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনা এভাবেই আড়ালে থেকে যায় বলে উল্লেখ করছেন শিশু অধিকার ফোরামের আব্দুছ সহীদ মাহমুদ। তিনি জানান, মেয়ে শিশুদের পাশাপাশি ছেলে শিশু ধর্ষণের সংখ্যাও বাড়ছে। সেইসঙ্গে ছেলে শিশুদের ধর্ষণের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্র এখন আরও বেড়েছে। গবেষণা বলছে কেবল মেয়ে শিশু নয়, ধর্ষিত হচ্ছে ছেলে শিশুও। আব্দুছ সহীদ মাহমুদ বলেন, ‘ছেলে এবং মেয়ের আনুপাতিক হিসাবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের যৌন নির্যাতনের সংখ্যা বেশি। কিন্তু ছেলেদের ধর্ষণের ঘটনা আগে সীমিত ছিল। বোর্ডিং স্কুল বা মাদ্রাসায় হতো। এখন সেই ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। লঞ্চ-ঘাটে, বাস টার্মিনালে কিংবা বিপণিবিতানে যেসব শ্রমজীবী শিশু থাকে কিংবা যারা পথশিশু তারাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের দ্বারাও ধর্ষণের ঘটনা হচ্ছে। তবে সেগুলো চার দেয়ালের বাইরে আসে না।’ এ ধরনের ঘটনা যে হারে হঠাৎ করে বেড়ে গেছে তেমনটি বলতে রাজি নন অনেকেই।

বাড়ছে নারী নির্যাতন

নারী নির্যাতনের সংখ্যা কি দিন দিন বাড়ছে? নাকি ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে আসছে বেশি? নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের অধীনে নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সেবায় গঠিত সরকারের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে ২০০০ সাল থেকে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকল্পটির পরিচালক আবুল হোসেন বলছেন, নির্যাতনের ঘটনাগুলো আগের মতোই ঘটে চলেছে। তবে তা প্রকাশ পাচ্ছে আগের তুলনায় বেশি। তিনি বলেন, আমাদের হিসাব মতে, সংখ্যা আসলে বাড়েনি বরং মানুষের প্রকাশ বেড়েছে। সাম্প্রতিককালে মিডিয়ার কারণে খবরগুলো আসছে। বিষয়গুলো ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কমিউনিটিতে সেটা জানাচ্ছে।

দেশের বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক তাদের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির আওতায় দেশের ৫৫টি জেলা থেকে নির্যাতনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গত বছরের জুন মাসে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ২ হাজার ৮৭৩টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পরের বছর সংখ্যাটি ৫ হাজার ৮টিতে পৌঁছায়। এই এক বছরে নারীর প্রতি প্রায় সব ধরনের সহিংসতাই বেড়েছে। এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, দরিদ্র নারীরা সচ্ছল নারীদের থেকে বেশি (৫৪ শতাংশ) সহিংসতার শিকার হয়েছেন। আর নারী নির্যাতনকারীদের ৮৮ শতাংশই পুরুষ। এই পুরুষরা নির্যাতনের শিকার নারীর পরিবারের সদস্য বা প্রতিবেশী। ব্র্যাকের জরিপ অনুযায়ী, নির্যাতনের বেশি ঘটনা ঘটে কুমিল্লা, বগুড়া, রাজশাহী, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায়। বছরের মে মাসে নির্যাতনের সংখ্যা বাড়ে। অন্যদিকে জানুয়ারি মাসে নির্যাতনের ঘটনা কম থাকে।

ব্র্যাকের পল্লী সমাজ নামের ওয়ার্ডভিত্তিক ও নারীকেন্দ্রিক সংগঠনের নেটওয়ার্কের সদস্যদের কাজে লাগিয়ে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীর পরিবার, প্রতিবেশী, পল্লী সমাজের সদস্যরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেসব তথ্য রাজধানীতে ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠান এবং প্রধান কার্যালয় এ তথ্য ডেটাবেইসে সংরক্ষণ করে। বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের মোট মামলা ছিল ১৭ হাজার ৭৫২টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ২২০টি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়েবসাইটেও গুরুত্বপূর্ণ মামলার তালিকায় ‘নারী নিপীড়ন’ শিরোনামে মামলার তথ্য দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এ শিরোনামে ১০০ মামলার কথা উল্লেখ আছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) করা ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন। ২০১৪ সালে এ জরিপ প্রকাশ করা হয়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নারী নির্যাতনের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত অর্থাৎ গত ১১ বছর দুই মাসে বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হত্যা ও আত্মহত্যা করেছেন ৫৬ হাজার ৬৫৬ জন নারী। পরিষদ যৌতুক, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ ও অন্যান্য নির্যাতনের পর হত্যা, নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা এবং অন্যান্যসহ মোট ৩৪টি নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। আর গত বছর পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৩৭৩টি। এর মধ্যে ২১২ জনকেই স্বামী হত্যা করেন। বছরটিতে ৫৪ জন নারী বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করেন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নারী অধিকার কমিটির চেয়ারপারসন অধ্যাপক মাহফুজা খানম এই সময়কে বলেন, আগের তুলনায় নারী নির্যাতনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। দেশের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়েছেন তা যেমন সত্য; তেমনি নির্যাতন পিছু ছাড়ছে না, তা-ও সত্য। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, ডিজিটাল সংস্কৃতি, আইনের কঠোর প্রয়োগ না হওয়া, ধনতান্ত্রিক সমাজের অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে নির্যাতন বাড়ছে।

দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে বিচার

ধর্ষণের মামলা চলাকালে বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা তৈরি করে বলছেন নারী অধিকার কর্মীরা। ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে এসব প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে কি ভাবছে রাষ্ট্র? মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ তুলছেন, জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়ার পরও অনেক ক্ষেত্রে জামিন পেয়ে যাচ্ছে অভিযুক্তরা। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘অপরাধ করে সহজে জামিন পাওয়া গেলে হয়ত অপরাধের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তবে অপরাধী জামিন পাবে না আইনজীবী হিসেবে তো সেটা বলা যায় না। সুতরাং ধর্ষণের ব্যাপারে যদি আলাদা সেল করা হয়, মামলার গতি তদারকি করা হয়, তাহলে এ ধরনের অপরাধ অনেকটা কমতে পারে।’

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে, বছরের পর বছর ধরে মামলা চলছে। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন শিশু অধিকার কর্মীরা। তবে এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিচারক স্বল্পতা এখানে একটি সংকট হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়া মামলা ঝুলিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ডিফেন্স ল’ ইয়ারের মানসিকতারও পরিবর্তন আনতে হবে।

কেবল বিচার নয়, সাজা কার্যকরেও দীর্ঘসূত্রতা

ঘটনা-১

গত বছরের ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় এক স্বাস্থ্যকর্মীকে গণধর্ষণের অপরাধে তিনজনকে মৃত্যুদ- দেন আদালত। একই রায়ে আদালত আসামিদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে অর্থদ-ও দেন। চট্টগ্রামের প্রথম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক রেজাউল করিম এই রায় দেন। দ-িত আসামিরা হচ্ছে বাঁশখালী উপজেলার দক্ষিণ জলদি গ্রামের শফি আলম শফি, একই এলাকার আহমদ আলীর ছেলে কালু এবং আবুল হোসেন। এদের মধ্যে শফি কারাগারে এবং বাকি দুজন পলাতক।

ঘটনা-২

২০১৩ সালের ৩০ জুন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এক কিশোরীকে অপহরণের পর গণধর্ষণের দায়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক রেজাউল করিম। দ-াদেশ পাওয়া আসামিরা হলেন বাঁশখালী উপজেলার পূর্ব চাম্বল গ্রামের রশিদ আহমেদ, মোহাম্মদ কেনু, নাসির, কবির আহমেদ ও নূরুল আবছার। তারা সবাই পলাতক।

আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ১৯৯৭ সালের ১১ এপ্রিল আসামিরা ১৬ বছর বয়সী ওই কিশোরীকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করেন। ওই সময় ওই কিশোরীর মাকে ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। পরে পাশের পাহাড়ে নিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের দায়ে বিচার হয়েছে এমন দুটো ঘটনায় দেখা গেছে রায় মৃত্যুদ- হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আসামিরা পলাতক। ধর্ষণের ঘটনায় প্রায় সব রায়ের অবস্থা একই। আসামিরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। যে কারণে রায় হলেও তা কার্যকর হয় না। মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী দিলরুবা সরমিন এই সময়কে বলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, আসামিরা প্রকাশ্য দিবালোকে ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ পুলিশ তাদের কিছুই বলছেন না। কারণ, ধর্ষণ কিংবা এ ধরনের নিকৃষ্ট অপরাধের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বেশির ভাগই স্থানীয় পর্যায়ে বেশ প্রভাবশালী। তাই তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।’

আরেক বিড়ম্বনা স্বাস্থ্য পরীক্ষা

ধর্ষণের ঘটনার পর মামলা করতে গেলে নারীর স্বাস্থ্যপরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্ট’ নামে একটি বিতর্কিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেন। সনাতন এই পরীক্ষা না করতে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিলেও কাজ হয়নি। হাইকোর্টের নির্দেশের আলোকে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি দিকনির্দেশনা তৈরি করে আদালতে দাখিল করেছে। তবে ওই দিকনির্দেশনায় পরীক্ষাটি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়নি। বলা হয়েছে, একান্ত প্রয়োজন না হলে এ পরীক্ষাটি করা যাবে না। এই দিকনির্দেশনার ব্যাপারে আদালতে এখনো শুনানি না হওয়ায় পদ্ধতিটি যথারীতি চালু আছে। এই পরীক্ষায় ধর্ষণের শিকার মেয়ে শিশু বা নারীর যৌনাঙ্গে চিকিৎসক আঙুল দিয়ে পরীক্ষা করে কতগুলো সিদ্ধান্ত জানান। বিশেষ করে নারী বা শিশুটি ‘শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত’ কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত টানেন চিকিৎসক। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বৈজ্ঞানিকভাবে এই পরীক্ষার কোনো গুরুত্ব নেই। তারপরও চিকিৎসা সনদে বিশেষ করে অবিবাহিত মেয়ের নারীর চরিত্র নিয়ে সংশয় প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হয়।

একটি বেসরকারি সংস্থার আবেদনের পর ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার স্বাস্থ্য ও স্বরাষ্ট্র সচিব বরাবর রুল জারি করেন। সেখানে এই বিতর্কিত পরীক্ষা কেন অবৈধ হবে না জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচিবকে ধর্ষণের শিকার মেয়েশিশু ও নারীদের জন্য নীতিমালা তৈরির নির্দেশ দেন। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, তা হলো পরীক্ষাটির ফলাফল অনুমানভিত্তিক। এটি ধর্ষণের শিকার মেয়ে শিশু ও নারী এবং চিকিৎসকের দৈহিক গড়নের ওপর নির্ভর করে। শিশু ও অল্প বয়স্ক নারীদের জন্য পরীক্ষাটি যন্ত্রণাদায়কও। আরও যে প্রশ্নটি উঠছে, তা হলো বিবাহিত নারীরা যখন ধর্ষণের শিকার হবেন, তখন ‘টু ফিঙ্গার্স টেস্ট’র কোনো যুক্তিই নেই।

–হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

 

পাঠকের মতামত: